নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার ::
বন্দুকযুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদক কারবারিদের প্রাণহানি বাড়ছে। তবুও থেমে নেই ইয়াবা পাচার। প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে মাদক পাচারকারীরা। নারী. পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে ধরা পড়ছে অনেক রোহিঙ্গা।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিদিন কোথাও না কোথাও অভিযান পরিচালনা করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা, আটক করে কারাগারে পাঠানো বা বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পরও থামছে না পাচারের কাজ।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে টেকনাফে ১০২ জন আলোচিত ইয়াবা কারবারি পুলিশের হাতে আত্মসমর্পণ করে। এরপর সকলে আশাবাদী ছিল, টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে ইয়াবা পাচার শূন্যের কোটায় নেমে আসবে। কিন্তু কিছুদিন থমকে থাকলেও ফের বিভিন্ন কৌশলে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা ঢুকছে। পাচারে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের। এরা সুযোগ বুঝে মিয়ানমারে পাড়ি জমাচ্ছে। আবার সেখান থেকে ইয়াবাসহ সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইয়াবা পাচারে রোহিঙ্গা নারীদেরও ব্যবহার করা হচ্ছে। নতুন নতুন পদ্ধতিতে পাচার হওয়ায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও তা থামাতে হিমশিম খাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর কক্সবাজার অফিসের সহকারী পরিচালক (এডি) সোমেন মন্ডল বলেন, পাচারকারীরা এতটা ডেস্পারেট হয়ে গেছে যে, মৃত্যুকে ভয় পাচ্ছে না। সাধারণ মানুষ অতি লোভের কারণে পাচার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এতে করে পাচার রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ১৯ মে থেকে চলতি বছরের ৩০ মার্চ পর্যন্ত কঙবাজারে বন্দুকযুদ্ধে ৬৩ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে ৪৭ জন নিহত হয়েছে ১৬ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারে ১০২ জন পাচারকারীর আত্মসমর্পণের আগে। ১৬ জন নিহত হয়েছে আত্মসমর্পণের পরে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আত্মসমর্পণ বা অভিযান অব্যাহত রাখার পরও ইয়াবাসহ মাদক পাচার বা এর ব্যবসা প্রত্যাশা অনুযায়ী কমেনি। তবে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন দাবি করেন, তাদের পদক্ষেপের কারণে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা অনেক কমেছে। তিনি বলেন, যারা আত্মসমর্পণ করেছে, এরা ছিল বড় মাপের ব্যবসায়ী। এখনো তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের অনেকে আত্মসমর্পণ করেনি। তার বাইরেও অনেক ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় আনতে পারিনি। তাদের ব্যাপারে তথ্য আমাদের কাছে কম ছিল। যারা আত্মসমর্পণ করেছে তাদের কাছ থেকে অনেক তথ্য পেয়েছি, নতুন নতুন নাম পেয়েছি। এখানে তাদের বড় সহযোগী ছিল হুন্ডি ব্যবসায়ী। তাদেরকেও আমরা চিহ্নিত করেছি। এই রুট দিয়ে এখন ইয়াবা প্রবেশ প্রায় ৮০ ভাগ বন্ধ হয়েছে।
কক্সবাজারে মাদকসেবীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠন নোঙ্গর-এর নির্বাহী পরিচালক দিদারুল আলম রাশেদ চকরিয়া নিউজকে বলেন, মাদক পাচারের রুট বেড়েছে। মাদকের চাহিদাও বেড়েছে। কারবারিদের কৌশলও বাড়ছে। মাদক প্রতিরোধে সরকারের পরিকল্পনা আগে থেকে ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। বহুমুখী কারণে মাদক পাচার রোধ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে তৃণমূল পর্যায়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। মাদক বন্ধ করতে হলে সম্মিলিতভাবে কর্মপন্থা নিরুপণ করতে হবে এবং তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি নীলিমা চৌধুরী চকরিয়া নিউজকে বলেন, ইদানীং মেয়েদেরকে মাদক পাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা নারীদেরও এই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। যারা ধরা পড়ছে, ওরা শুধু বহনকারী। অভাবের তাড়নায় বেশির ভাগ নারী এ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে টেকনাফসহ কক্সবাজারে বিকল্প কর্মসংস্থানের প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে।
অবৈধ মাদক ব্যবসা এবং পাচার নিয়ে কাজ করা ‘হেল্প কক্সবাজারে’-এর নির্বাহী পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, সরকারের পদক্ষেপে কোথাও যেন ঘাটতি রয়ে গেছে। তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই মাদক পাচার রোধ করা সম্ভব হবে। মাদক পাচার কয়েকটি ধাপে পরিচালিত হয়। এসব ধাপ চিহ্নিত করতে হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
তিনি বলেন, ১০২ জন পাচারকারী আত্মসমর্পণ করেছে। পাচারও বাড়ছে, অভিযানও চলছে। কিন্তু এর প্রভাবটা সেভাবে আসছে না। সামগ্রিকভাবে যে লড়াই চলছে তা এগিয়ে নিতে যেন কোনো ছাড় দেওয়া না হয়।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন চকরিয়া নিউজকে জানান, কোনো অবস্থাতেই মাদক পাচারকারীরা ছাড় পাবে না। মাদক ছাড়তে হবে না হয় কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পাচার হওয়ার প্রধান রুট হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়াকে চিহ্নিত করে পুলিশ। এখান দিয়ে ইয়াবা এসে চলে যাচ্ছে সারা দেশে। গত বছরের ৪ মে থেকে ইয়াবাসহ অবৈধ মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযানে সারা দেশে এ পর্যন্ত বন্দুকযুদ্ধে ৩২৫ জন নিহত হয়েছে।
পাঠকের মতামত: